বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৮ অপরাহ্ন

আ.লীগ/কে ফেলে দেওয়ার জন্য যা দরকার ছিল, সব করেছি : সিবগা/তুল্লাহ..

প্রতিবেদকের নাম
  • প্রকাশের সময়ঃ বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫
  • ১৩ বার পঠিত হয়েছে
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ সিবগা। ছবি : সংগৃহীত

ছাত্ররাজনীতির ভেতর থেকে উঠে আসা এক সক্রিয় সংগঠকের কণ্ঠস্বর সিবগাতুল্লাহ সিবগা। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তার সম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক বাধা, ছাত্রসংগ্রামের চরিত্র এবং রাজনৈতিক ঐক্যের প্রেক্ষাপটে নিজের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন সিবগাতুল্লাহ সিবগা।

সম্প্রতি বাসসকে দেওয়া সিবগাতুল্লাহ সিবগার একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ছাত্ররাজনীতির বাস্তব চিত্র, আন্দোলনের অন্তর্গত কৌশল এবং ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা।

প্রশ্ন : আপনি বর্তমানে কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত? এ বিষয়ে কিছু বলুন এবং এখন আপনার পদবি কী?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : আমি বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক। এর আগে ২০২২ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলাম। এরপর ২০২৫ সেশনে অফিস সম্পাদকের দায়িত্বে আছি।

প্রশ্ন : আপনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন, তখন কি ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ ছিল? সে সময়ে আপনারা কীভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ছাত্রশিবির কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল না। তবে আপনারা জানেন, ফ্যাসিস্ট সরকার একপর্যায়ে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ততদিনে তাদের বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। এ ছাড়া সরকার অবৈধভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিবিরের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। দেশে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা চালু ছিল, যেখানে ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করা হতো না। এ অবস্থায় তারা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ওপরও দমন-পীড়ন চালাত। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, ছাত্রদলের কেউই ক্যাম্পাসে থাকতে পারত না। একইভাবে শিবিরসহ অন্য কোনো দলও সংগঠনের পরিচয়ে টিকতে পারেনি।

সংগঠন হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে বিভিন্নভাবে অবদমনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিবির কোনোদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেনি। ছাত্রশিবিরের কাজ মূলত নৈতিক ও একাডেমিক। আমরা পড়াশোনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ফোকাস করি। মিছিল-মিটিং আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না, সেগুলো সচরাচর করিও না। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, নিয়মিত বৈঠক এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো বজায় রাখা—এই বিষয়গুলোতে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিই।

প্রশ্ন : ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনি কীভাবে এবং কখন যুক্ত হলেন? ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনেও কি আপনার ভূমিকা ছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : কোটা আন্দোলনকে কেবল ২০১৮ সাল থেকে শুরু বলা ঠিক হবে না। এটি দীর্ঘদিনের লড়াই। ১৯৯৬-৯৭ সালে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার সময় থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির এই ইস্যুতে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এরপর ২০০৮ ও ২০১৩ সালে আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোতেও আমরা ছিলাম। সবশেষে ২০১৮ সালের আন্দোলন। তাই এটিকে শুধু ২০১৮ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে না।

২০১৮ সালের আন্দোলনের সময় আমি ঢাবির ছাত্র ছিলাম। মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। সেসময় আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। জনমত গঠন, আমাদের জনশক্তিকে আন্দোলনে যুক্ত করা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। যেহেতু ওই সময় আন্দোলনে অরাজনৈতিক গোষ্ঠী সামনের সারিতে ছিল, তাই সাংগঠনিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরই সর্বাত্মক সহায়তা করেছে।

প্রশ্ন : ২০২৪ সালের জুনে কোটা বাতিলের পর ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়। তখন আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : কোটা বাতিলের পর আমরা অভ্যন্তরীণ বৈঠক করেছি। আলোচনা করেছি যে, আন্দোলনে আমরা কীভাবে অংশ নেব। আমাদের বড় দাবি ছিল, চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, কোটা নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে করেই হোক কোটাব্যবস্থা যাতে পুনর্বহাল না হয়, সেটি প্রতিরোধ করতে হবে।

প্রশ্ন : সে সময়ে প্রশাসন কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিল? এবং আপনারা কীভাবে সেগুলো মোকাবিলা করেছেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : প্রশাসনের উচ্চপদস্থরা মূলত সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। তারা কোনোভাবেই চাননি আন্দোলন সফল হোক। কর্মসূচিগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এক প্রকার অসহযোগিতা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িও ছিল। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে তারা বড় কোনো দমনমূলক পদক্ষেপ চাপিয়ে দিতে পারেনি।

প্রথমে হল প্রভোস্ট এবং পরে ছাত্রলীগের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষার্থীরা যেন হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য তাদের চিহ্নিত করা এবং দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন : চব্বিশের কোটা আন্দোলন-পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যেখানে বাম-ডান সব মতাদর্শের দল অংশ নিয়েছিল। সবাই একত্রিত হওয়ার পেছনে কী কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : কোটা ব্যবস্থা বাতিল হোক, এটা সব শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের চাওয়া ছিল। কিন্তু যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামা ছাত্রদের ওপর যখন গুলি চালানো হলো, তখন তারা দ্রোহ করেছে। সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছে, আমরা তোমাদের মানি না। ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, আমরা দাবি আদায়ের জন্য নামব আর তুমি (সরকার) গুলি করবা! তা তো হবে না। বিশেষ করে আবু সাইদের গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ সমসাময়িক অসংখ্য ঘটনায় সব শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। আর তাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে নেমে আসে সব রাজনৈতিক দল।

প্রশ্ন : ১৫ জুলাইয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাই। সেদিন ছাত্রলীগ ভিসি চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। আপনারা দলীয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কি? কীভাবে প্রতিরোধ করেছেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ঘটনার শুরু মূলত ১৪ জুলাই। ওইদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজাকারে বাচ্চা বলেছিলেন। তখন আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম না; কিন্তু খবর পাই রাতে কয়েকটি হলে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগ দিয়ে শেখ হাসিনা যে ফ্রেমিং করেছিলেন সেটিকে সবাই নিজের ওপর নিয়ে স্লোগান দেয় ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার!!’

এর প্রতিবাদে পরদিন পুরো ক্যাম্পাসে মিছিল হয়, সেখানে আমরাও ছিলাম। হলের মেয়েরাও তালা ভেঙে যোগ দেয়। প্রায় সব শিক্ষার্থী মিছিলে অংশ নিয়েছিল।

তখন অবশ্য মনে হয়েছিল, ক্যাম্পাসে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা আওয়ামী বয়ানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ওই দিনের কর্মসূচিতে সরকার বা ছাত্রলীগ হার্ডলাইনে যেতে পারে আশঙ্কায় আমরা সেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম।

এর বাইরে, ১৫ তারিখে যখন খবর আসে ‘বিজয় ৭১’ হল থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না, তখন রাজুতে অবস্থান নেওয়া মিছিলের একটি অংশ ক্যাম্পাসের দিকে মুভ করে। আপনারা জানেন, সেই মিছিলেও হামলা চালানো হয়। হামলার অসংখ্য ফুটেজ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাত আসে। সেখানে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নারীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। সব ফুটেজ সংগ্রহ করে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ঢাবি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তা যাতে সবাই জানতে পারে। এই জায়গাটাতে অনেকগুলো স্টেকহোল্ডার চমৎকারভাবে কাজ করেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সাংবাদিকতা করেছে। এ ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সার ও ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত গণমাধ্যমকর্মীদেরও সহযোগিতা পেয়েছি।

প্রশ্ন : ১৫ তারিখে শহীদুল্লাহ হলে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেদিন ওই হলটিতে মূলত অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল। বলা হয়, শিবিরের শক্ত ভূমিকার কারণেই ছাত্রলীগ সেদিন সেখানে ঢুকতে পারেনি। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সেদিন শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়, এমনকি হাসপাতালেও হামলা চালানো হয়েছিল। ওই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আমাকে ফোন দিয়ে সব জানায়। দেখলাম, হামলায় আহতরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেছে; কিন্তু সেখানেও হামলার শিকার হচ্ছে। সে সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও ঢাকা মহানগর পূর্বসহ বেশ কয়েকটি শাখাকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে। তারা লাঠিসোটা নিয়ে সেখানে যায়। তাদের বলি, মিছিল নিয়ে মেডিকেল হয়ে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে চলে যেতে। একই সঙ্গে জানানো হয়, সমন্বয়করা ভয় পাচ্ছে পরদিনের কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত লোক না থাকলে কর্মসূচি ঘোষণাটা একটু কঠিন হতে পারে। পরবর্তীতে দুই মহানগরীর কিছু জনশক্তি এসে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দেয়। ওই সময়টাতেই মূলত সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

প্রশ্ন : আপনি বলতে চাচ্ছেন ১৫ তারিখ রাতের সংবাদ সম্মেলনটা মূলত আপনারাই অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছিলেন?

সিবগাতুল্লাগ সিবগা : হ্যাঁ, ঠিক তাই। আশপাশের পুরোটা জুড়েই আমাদের জনশক্তি ছিল। কয়েকটা গ্রুপকে প্রস্তুত রেখেছিলাম ক্যাম্পাসের আশপাশে, যাতে যে কোনো সময় যে কোনো হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

প্রশ্ন : সরকার পতনের সময় অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সে সময় ছাত্রশিবির কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল নির্দিষ্ট করে জানাবেন।

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ১৬ তারিখ ক্যাম্পাসের অবস্থা ছিল বেশি ক্রিটিক্যাল। ওইদিন সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ওই দিনের পর থেকে আন্দোলনটা অন্য মাত্রায় মোড় নেয়।

আরেকটা বিষয়, কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কোটা ইস্যুতে সবচেয়ে বড় মিছিলটিও হয়েছিল ওইদিনই। সেটি শিবিরই করেছিল। দেশের সব গণমাধ্যমেই এ খবরটি প্রচার করা হয়। মিছিলের পর আমাদের জনশক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নিতে থাকে।

মহানগরসহ কয়েকটি কলেজ শাখার জনশক্তি ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও সায়েন্সল্যাবে অবস্থান নেয়। আমাদের মূল ফোকাস ছিল, সবার দৃষ্টি ওই স্থানগুলোতে আকৃষ্ট করা। যাতে ক্যাম্পাসের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে পারে। নির্দেশনা ছিল মিছিল করে করে পরে সবাই ক্যাম্পাসের দিকে আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

একই সঙ্গে চানখাঁরপুল এলাকায় যে মারামারি হয়, সেখানে হাজী সেলিমের একটা গ্রুপও ছিল। তখন শিবির মূলত সেখানে ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়েছিল যাতে হাজী সেলিমের লোকজন ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে। একই সময়ে শিক্ষার্থী প্রচুর লাঠি সংগ্রহ করে জড়ো করে ক্যাম্পাসে ও শহীদ মিনারে। এর মধ্যে একটা বড় অংশ বাইরে থেকে আমাদের জনশক্তির সরবরাহ করা। সেদিন সারা দেশে আবু সাইদসহ কমপক্ষে ৬ জন শাহাদত বরণ করে। ওই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা লাঠিসহ হলে প্রবেশ করে। রাতের বেলা তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একের পর এক হল এবং ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে।

প্রশ্ন : এটা কি আসলে শিবিরের নেতৃত্বে হয়েছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : এটা সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে হয়েছিল। তবে শিবিরেরও এখানে বড় ভূমিকা ছিল, বলা যায়। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীরাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে থাকতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। যারা তাদের ভাইদের হত্যা করেছিল, তাদের সঙ্গে হল শেয়ার করা নিয়ে সবার মনেই ক্ষোভ ছিল। শিক্ষার্থীরা ভেবেছিল, যে ছাত্রলীগ এতদিন গেস্টরুমে নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসেছে।

প্রশ্ন : ১৭ তারিখের গায়েবানা জানাজা কীভাবে আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ১৭ তারিখ সকালেই সব হল থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, প্রশাসনেরও ক্যাম্পাস খালি করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ক্যাম্পাস না ছাড়ার। পরে দেখা গেল, আর থাকা সম্ভব নয়। তখন সবাই ধীরে ধীরে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়। সেখানেও সাউন্ড গ্রেনেডসহ নানা হামলা চালানো হয়।

সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে ফোন করে বলা হয়, নিউমার্কেটে ১৬ তারিখের সংঘর্ষে শহীদ হওয়া একজনের লাশ ক্যাম্পাসে আনা যায় কি না। সেটা সম্ভব হয়নি। পরে খবর পাই, কামরাঙ্গীরচরেও একজন মারা গেছেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারি লাশের জানাজা পড়তে দেওয়া হয়নি; সরাসরি গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে লাশ না পেয়ে ছাত্রশিবিরের তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পাসে অনেকগুলো প্রতীকী কফিন নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রশ্ন : যখন শিক্ষার্থীদের ধরপাকড় শুরু হয়, তখন কীভাবে তা এড়িয়েছিলেন? ওই সময় আপনার পরিবার এবং আপনি কি কোনো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বা বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন? কীভাবে তা মোকাবিলা করেছিলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : পুরো সময়টাই আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আমাকে তো আগে থেকেই শিবিরের নেতা হিসেবে সবাই চিনত। ঢাবির সাবেক দায়িত্বশীলদের একজন হিসেবে ১৬ তারিখ শিবিরের মিছিলেও ছিলাম। গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যরা আমাদের খুঁজছিল—সেই খবরও পেয়েছিলাম। তবুও মাঠে থাকার লক্ষ্য থেকে সরে আসিনি।

কিছু সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম। যতদিন নেটওয়ার্ক ছিল, ততদিন অনলাইন ব্যবহার করেছি; অফলাইন এড়িয়ে চলেছি। নেটওয়ার্ক বন্ধ হলে এক ফোন একাধিকবার ব্যবহার করিনি। এভাবে মাঠপর্যায়ের যোগাযোগ ধরে রেখেছি। ঢাকা শহরের কোথায় কোথায় ছাত্ররা নামছে, সেখানে আমাদের কারা আছে, সবসময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। এই নেটওয়ার্ক মেইনটেইন করতে গিয়ে যে কোনো সময় গ্রেপ্তার বা নির্যাতনের ঝুঁকি ছিল।

প্রশ্ন : আপনি কি কখনো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন? এরকম কোনো ঘটনা থাকলে বলুন।

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : হ্যাঁ, আছে। ৪ তারিখের ঘটনা বলি। আমরা বেলা ১১টার দিকে শাহবাগে পৌঁছাই। তখন পিজি হাসপাতালের পাশ থেকে ছাত্রলীগ গুলি চালানো শুরু করে। তখনো সেখানে জনসমাগম হয়নি; আমরা মাত্র কয়েকজন ছিলাম। গুলি শুরু হলে আমরা ইটপাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ করি। তাদের গুলিতে আমাদের কয়েকজন আহত হন। তার পরও আমরা তাদের হটাতে সক্ষম হই। এর ফলে ৪ তারিখ শাহবাগে ভালোভাবে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়। বিকেলে খবর আসে সায়েন্সল্যাব ও ঝিগাতলায় ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। তখন শাহবাগ থেকে আমরা ৭-৮ শতাধিক মানুষ নিয়ে ঝিগাতলার দিকে যাই। সেখানে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও অন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে মাগরিব পর্যন্ত।

প্রশ্ন : পুরো সময় আপনি কি আন্দোলনের নেতৃত্বে মাঠে ছিলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : হ্যাঁ, ছিলাম।

প্রশ্ন : ঢাবি বন্ধ ঘোষণার পর আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ওই সময়ে কীভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্দোলনকে জিইয়ে রাখল? এতে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা কী ছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া আমাদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

প্রশ্ন : কেন তাদের যুক্ত করার কথা মনে হয়েছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ঢাবিসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবাইকে হল ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকায় মেসে থাকত। তখনো প্রাইভেট বন্ধ হয়নি, ফলে তারা রাজধানীতেই ছিল। অনেকের বাসাই ছিল এখানে। সুতরাং তাদের রাস্তায় নামানো গেলে আন্দোলন কার্যকর রাখা সম্ভব ছিল। সেই পরিকল্পনা করেই তাদের যুক্ত করা হয়।

প্রশ্ন : কোন সিদ্ধান্তগুলো এই আন্দোলনকে সফল করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল ‘৯ দফা’ ঘোষণা।

প্রশ্ন : ৯ দফার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ৯ দফা মূলত আমাদের পক্ষ থেকেই তৈরি করা হয়েছিল। নেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরদিনের কর্মসূচি কাউকে না কাউকে ঘোষণা করতে হতো। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি গ্রুপ ৯ দফা প্রস্তুত করে, যা পরে আমরা চূড়ান্ত করি। আপনারা জানেন, ৯ দফা আব্দুল কাদেরের মাধ্যমে দেওয়া হয়। আমাদের একাধিক অপশন ছিল। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সে দিতে পারে। আন্দোলন-সংগ্রামের সময়টাতে আগে থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এজন্য তার মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে ৯ দফা। কিন্তু তার তো প্রতিটি জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা ছিল না। সেজন্য আমরা প্রিন্ট করে অনেকগুলো মিডিয়া হাউসে পৌঁছে দেই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সহযোগিতা নিই। আমাদের ৯ দফা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম বড় জায়গা ছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়া। আব্দুল কাদেরকে মূলত সেইফ হোমে রাখা হয়েছিল, আমিই রেখেছিলাম। সেখান থেকে তার ৯ দফা ঘোষণার ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পাঠানো হয়।

ওই সময়ে এভাবে প্রতিদিন কর্মসূচি দেওয়া এবং পরদিন কী করা হবে, তা ঠিক করা হতো। নেট বন্ধ হওয়ার আগে বিষয়গুলো সমন্বয়করা দেখত। কিন্তু নেট বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আন্দোলন এক প্রকার স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। মানুষজন রাস্তায় শহীদ হচ্ছে, এ অবস্থায় পরদিনের কর্মসূচিটা আসলে কে দেবে? এই জায়গায় ইসলামী ছাত্রশিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঢাকা শহরে কোথায় কোন জায়গায় কে আন্দোলন করছে, কীভাবে করছে, ঢাকা সিটির প্রবেশপথ থেকে শুরু করে অন্যান্য জায়গায় খবর ছড়িয়ে দেওয়া বা বার্তা পৌঁছানোর কাজটি আমাদের জনশক্তিই করেছে। এটি যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করি।

প্রশ্ন : এ ধরনের আরও কোনো ঘটনা আছে?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : অসংখ্য ঘটনা আছে। পরদিনের কর্মসূচি কী হবে, তা সবাই মিলে বসে ঠিক করতাম। কখনো সমন্বয়করা জেলে থাকতেন, তবুও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো।

প্রশ্ন : আন্দোলন শুরুতে শুধু শিক্ষার্থীদের ছিল, পরে সাধারণ মানুষও যোগ দেয়। এখানে আপনারা কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন কি?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : অবশ্যই। সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের ভুক্তভোগী ছিল। ফলে তারা মাঠে নামতে প্রস্তুত ছিল। সাংগঠনিক অবস্থান থেকে আমরা যখন রাস্তায় নেমেছি, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আমাদের সঙ্গে নেমেছে। নানা বয়সের মানুষও এসেছে। আমরা লোকেশন নির্ধারণ করে দিতাম। যেমন, ‘আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলন হবে’। যাতে সাধারণ মানুষও সেখানে অংশ নেয়, তা নিশ্চিত করতে বলতাম।

প্রশ্ন : ৯ দফা থেকে এক দফায় রূপান্তর কীভাবে হলো? চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা: ৯ দফার মধ্যেই এক দফার বীজ ছিল। এসব দাবির বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না। ফলে মানুষ এক দফার দিকে চলে যায়। ২০ তারিখ থেকে সবাই এক দফার দাবিতে সরব হয়ে ওঠে। অবশ্য তার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সাধারণ মানুষ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। এক দফা আসলে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল। তারা মনে করেছে, এত নিরীহ মানুষ মারা গেল, তার পরও কেন একটি অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় রাখব?

প্রশ্ন : গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : অবশ্যই, বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। যে কারণে ফ্যাসিবাদী শক্তি বাংলাদেশে উত্থান হয়েছিল সেটির সংস্কার দরকার। কিন্তু এখন যা দেখছি, তা হলো ক্ষমতায় পরিবর্তন হলেও শুধু জনবল বদলাবে, সিস্টেম আগের মতোই থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের জায়গায় অন্য কেউ আসবে; কিন্তু আবারও ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকেই যাবে। জনমতকে উপেক্ষা করা, তাদের দাবি না শোনা, সবই আগের মতো রয়ে গেছে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গভীর পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আসেনি।

প্রশ্ন : যদি এই আন্দোলন সফল না হতো, তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন হতো বলে আপনি মনে করেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সফল না হলে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হতাম। বিশেষ করে, সংগঠন হিসেবে আমরা তো নিষিদ্ধই হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ভাইদের নিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। বিভিন্ন মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে আমাদের বিচার করা হতো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা আন্দোলনে নেমেছিল, তারাও নিপীড়নের শিকার হতো। আসলে সে সময় অনেক কিছুই হয়েছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী জেলে গেছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা তো আসলে মুক্ত ছিলাম না। মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে আরও ১০-১৫ বছর এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাই যা করার, এ মুহূর্তেই করতে হবে। আওয়ামী লীগকে ফেলে দেওয়াটা তখন খুব দরকার ছিল।

প্রশ্ন : আন্দোলন সফল না হলে সাধারণ শিক্ষার্থী বা জনগণের সঙ্গে কী হতো বলে আপনি মনে করেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : তাহলে ফ্যাসিবাদী শক্তি আরও শক্তভাবে আসন গেড়ে বসত। মানুষের ন্যায়বিচারের অধিকার হারিয়ে যেত। গুম, খুন, হত্যা আগের চেয়ে আরও বেড়ে যেত।

প্রশ্ন : উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে কোনো মিল আছে কি? একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পৃক্ত কি না?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : কিছু মিল অবশ্যই আছে। তবে প্রতিটি আন্দোলন একেক প্রেক্ষাপটে হয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বড় ছিল। কিন্তু চব্বিশের শেষ দিকে সব শ্রেণির মানুষ এতে অংশ নিয়েছিল। এই আন্দোলনে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যা অন্য অভ্যুত্থানগুলোতে হয়নি। এই কারণে চব্বিশকে আমি বিপ্লব মনে করি। এত মানুষের জীবন যাওয়ার পরও মানুষ রাস্তায় থেকে গেছে, দাবি আদায় করে ছেড়েছে। এই দিক থেকে চব্বিশ কিছুটা ভিন্ন।

প্রশ্ন : আন্দোলনের শেষ দিকে ‘লাল বিপ্লব’, অর্থাৎ ফেসবুক প্রোফাইল লাল করা, ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’, রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি প্রদান, ‘মার্চ টু বঙ্গভবন’, ‘বাংলা ব্লকেড’-এই টার্মগুলো কীভাবে এলো? এতে শিবিরের কোনো ভূমিকা ছিল কি?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : এসব কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে আমরা ছিলাম। সমন্বয়করা সামনের সারি থেকে ঘোষণা দিতেন; কিন্তু ভেতরের বোঝাপড়াটা সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিল।

প্রশ্ন : এসব বিষয়ে ডিল করার জন্য আপনারা শিবির থেকে কাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সাদিক কায়েমকে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। আন্দোলনটিও ঢাবিকেন্দ্রিক ছিল। প্রথমে আমরা সাংগঠনিক মিটিং করতাম, কেন্দ্রের ৪-৫ জন নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতাম। এরপর সাদিক সেই অনুযায়ী কর্মসূচি ঘোষণা করত। ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার ধারণা আসে ঢাবির এক সেক্রেটারি মারুফের কাছ থেকে, যা ফরহাদ উপস্থাপন করেছিল।

প্রশ্ন : আপনারা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন। কেন মনে করেছিলেন এটি করা দরকার?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : এটি আন্দোলনের প্রথম দিকের ঘটনা। যে কোনো আন্দোলনের লক্ষ্যই থাকে দাবি আদায়। প্রথমে আমরা আলোচনা করে সমাধান খুঁজতে চেয়েছিলাম। এরপর বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। সে হিসেবেই রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

প্রশ্ন : ডিবি কার্যালয় থেকে আন্দোলন থামানোর ভিডিও বার্তা দেওয়া হয়েছিল। সেটি আপনি কীভাবে নিয়েছিলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : দেখেছিলাম ৬ জন সমন্বয়ক ডিবি কার্যালয় থেকে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষও তা দেখেছিল। কিন্তু তখন আমরা আন্দোলনের পিকে ছিলাম। কারও কথা শোনার সুযোগই ছিল না। আর এই আন্দোলন এক বা দুজন ব্যক্তির নয়, এটি ছিল মাস পিপল এবং সব ছাত্রের। ৬ জন বা অন্য ৩ জন সমন্বয়কের ঘোষণায় আন্দোলন থেমে যাবে, এমনটি ছিল না। আপনারা দেখেছেন, সেই ঘোষণা আসার পরপরই আমরা ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করি এবং যার যার মতো করে কর্মসূচি চালিয়ে যাই।

প্রশ্ন : ৩ আগস্ট এক দফা ঘোষণা হওয়ার পর ৪ তারিখ আসিফ মাহমুদ (বর্তমানে উপদেষ্টা) ভিডিও বার্তায় জানান, ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখে হবে। এর কারণ কী?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : আমাদের পক্ষ থেকেই এক দিন এগিয়ে আনার দাবি ছিল। কারণ ৪ তারিখের সংঘর্ষে শতাধিক প্রাণহানি ঘটে। পরদিন সফট কর্মসূচি পালনের কোনো সুযোগ ছিল না।

প্রশ্ন : এ কর্মসূচির জন্য আপনারা কীভাবে সবাইকে রাজি করালেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে। তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা সীমিত ছিল, তারা জানত না কতজন লোক আসবে। আমাদের পক্ষ থেকে আত্মবিশ্বাস ছিল, কারণ আমাদের জনশক্তি ছিল অনেক বেশি।

প্রশ্ন : আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, পুরো আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে শিবির মূল চালিকাশক্তি ছিল?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : শিবিরের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

প্রশ্ন : ৫ আগস্টের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বলুন। সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন, কী করেছেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সেদিন সারাদিন শাহবাগেই ছিলাম। মাঝে কিছু সময় বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে দেখেছি।

প্রশ্ন : সময়ক্রম ধরে বললে ভালো হতো। কীভাবে শাহবাগে প্রবেশ করেছিলেন এবং কখন জানলেন শেখ হাসিনা চলে গেছেন? তখন কী করলেন?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : আমরা ৩ তারিখ রাতেই বুঝেছিলাম বড় কিছু হতে যাচ্ছে। ৫ তারিখ শাহবাগে গিয়ে দেখি সেনাবাহিনী মোতায়েন। একে একে শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছিল এবং ভাবছিল কীভাবে শাহবাগে প্রবেশ করবে। তখন আমি বলি, ‘মেইন রাস্তায় দাঁড়ানো সম্ভব নয়, চলুন ভেতরের দিকে যাই।’ এরপর আমরা পিজি হাসপাতালের দিকের গলিতে অবস্থান নেই, সেখানে তিন-চার হাজার মানুষ একত্রিত হয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তারপর মিরপুর ও উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গ্রুপগুলোকে শাহবাগে আসতে বলা হয়। সেখান থেকে কয়েকটি দল গণভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করি। রাতের বেলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কাকে চাচ্ছি কী চাচ্ছি, তা নিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করি।

প্রশ্ন : সবশেষে আন্দোলন নিয়ে বিশেষ কিছু বলার আছে?

সিবগাতুল্লাহ সিবগা : পুরো আন্দোলনটাই ছিল অনেক কঠিন। বিশেষ করে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির দিন আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। মনে হয়েছিল আর পারছি না। সবাইকে নামাতে কষ্ট হচ্ছিল। ওটা ছিল জজকোর্ট-হাইকোর্টকেন্দ্রিক প্রোগ্রাম, কারণ সেখানে অলরেডি আমাদের লোকজন ছিল। ভেবেছিলাম চাপ কম হবে। কিন্তু সেদিনও চাপ নিতে হয়েছিল। তার পরও সবকিছুর জন্য, আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কর্মসূচি কোনোদিনই খারাপ হয়নি। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় কর্মসূচিগুলো সফলভাবে পালন হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৫ আগস্ট আমরা সবচেয়ে বড় বিজয় অর্জন করেছি।

প্রসঙ্গত, সিবগাতুল্লাহ সিবগা উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা সেখানেই শেষ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে এমডিএস করছেন।

এই নিউজটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও খবর