হিন্দু পুরোহিতের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরায় ভারতের শীর্ষ ফ্যাক্ট-চেকার ও সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। ফলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জুবায়েরকে জামিন দিয়ে ‘অবিলম্বে মুক্তির’ নির্দেশ দেয়ার দুই বছর পর ফের আদালতে ফিরতে হলো এই ফ্যাক্ট-চেকারের।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) উত্তর প্রদেশ পুলিশের দায়ের করা একটি নতুন মামলায় তার আবেদনের সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন এলাহাবাদ হাইকোর্ট। তার বিরুদ্ধে ‘ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার’ অভিযোগ এনেছে পুলিশ। জামিন-অযোগ্য এই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে অন্তত সাত বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। মঙ্গলবার শুনানি শুরু হওয়ার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে বিচারকরা মামলা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেন। এর ফলে এখন অন্য কোনো মামলাটির আদালতে শুনানি হবে।
ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জুবায়ের তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমার কাজের জন্যই আমাকে টার্গেট করা হচ্ছে।’ জুবায়েরের সহকর্মী এবং অল্টনিউজের অপর এক সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন, কর্তৃপক্ষের জুবায়েরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের কারণ তার কাজের ধরন এবং তার কাজের প্রভাব। তার কথায়, ‘প্রায় দুই মাস পর কেন তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অভিযোগ আনা হলো? শুধু নরসিংহানন্দ আর তার সমর্থকদের ওর পেছনে লাগেনি—আসলে সরকারও ওর পেছনে লেগেছে।’ মানবাধিকার ও সংবাদকর্মীদের সংগঠনগুলো জুবায়েরের বিরুদ্ধে আনা এই মামলার কঠোর সমালোচনা করেছে।
জুবায়েরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে মূলত গত ৩ অক্টোবর এক্সে করা একটি পোস্টের কারণে। ওই পোস্টে তিনি বিতর্কিত হিন্দু পুরোহিত ইয়াতি নরসিংহানন্দের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। জুবায়েরের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, নরসিংহান্দ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। ৬০ বছর বয়সি নরসিংহানন্দ উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের দাসনা দেবী মন্দিরের প্রধান। তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সহিংসতার আহ্বান জানিয়ে বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন। ২০২২ সালে ইসলামবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন এক মাস কারাগারেও ছিলেন তিনি।
জুবায়ের নরসিংহানন্দের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরে পোস্ট করার একদিন পর মন্দিরের বাইরে বিক্ষোভ করেন মুসলমানরা। পুলিশের বরাত দিয়ে পিটিআই জানিয়েছে, বিক্ষোভের সময় পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেক মুসলিম নরসিংহানন্দের বিরুদ্ধে পুলিশেও অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন বলেও কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও পুলিশ বলেছে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
জুবায়েরের আইনজীবী তার অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেছেন এবং মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেছেন। জুবায়ের বলেন, তিনি একাই অনলাইনে নরসিংহানন্দের বক্তব্য পোস্ট করেননি। তার আগেই আরো অনেক সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যম ওই ভিডিও টুইটারে শেয়ার করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্রমাগত ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, এমন একজন মানুষের অনুসারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করেছে পুলিশ। ঘৃণামূলক বক্তব্যের খবর তুলে ধরছে এমন মানুষের পেছনে লেগেছে তারা, অথচ ঘৃণামূলক বক্তব্য দেয়া মানুষ মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেসব মানুষ সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করছে, তাদের কণ্ঠ রোধ করার প্রচেষ্টা এটি।’
এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া বলেছে, আইনকে ব্যবহার করে কীভাবে বাক-স্বাধীন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গায়ক, অভিনেতা ও লেখকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও নিপীড়ন করা হয়, তার উদাহরণ জুবায়েরের বিরুদ্ধে করা এই মামলা। এর আগে ২০২২ সালেও জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করে সমালোচনার শিকার হয়েছিল ভারত সরকার। তখন তিন সপ্তাহের বেশি সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছিল এই সাংবাদিককে।