মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে বেলে-দোয়াশ মাটির সেই বিশাল ধু-ধু চর এখন সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে। চরের দিগন্ত জুড়ে লতানো গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে কেবল তরমুজ আর তরমুজ। এবার যে কোনো দিকে চোখ ঘোরালেই ছবির মতো দেখা মিলবে চাষিদের ক্ষেত থেকে তরমুজ তোলার মনোহর দৃশ্য।
চাষিদের কেউ করছেন শেষ পর্যায়ের ক্ষেত পরিচর্যা। কেউ করছেন কাস্তে হাতে লতানো গাছের বোঁটা থেকে তরমুজ কেটে ক্ষেতে সারি সারি স্তূপ করার কাজ। কোথাও আবার দেখা মিলবে দল বেঁধে কৃষি শ্রমিকের ঠেলায় কিংবা ট্রলিতে তুলে নদীর ঘাটে নিয়ে ট্রলারে ভর্তি করে ভালো বাজার দরের আশায় পাইকার কিংবা কৃষকের স্থানীয় হাটে বাজারে অথবা মোকামে ছুটে চলার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যগুলো।
করোনার লক ডাউনে পরিবহন সংকট, নোনা পানির হানা, ভাইরাসের আক্রমণের মতো বৈশ্বিক বৈরীতায় পরপর কয়েক বছরে ধকল কাটাতে এবার আবাদ বাড়িয়ে আবহাওয়া ভালো থাকায় বাম্পার ফলন পেয়ে খুশি পটুয়াখালীর বাউফলের তেঁতুলিয়া নদী বেষ্টিত বিভিন্ন চরের তরমুজ চাষিরা। চোখে মুখে এখন তাদের হাসির ঝিলিক।
ইতোমধ্যে আগাম জাতের তরমুজ স্থানীয় হাট-বাজারসহ বিভাগীয় শহর বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, ভৈরব, চাঁদপুর থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন মোকামেও পাঠানো শুরু হয়েছে। বাজার দর কিছুটা ওঠা নামা করলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তেঁতুলিয়ার চরের সুস্বাদু রাঙা তরমুজের সুনাম ও কদর থাকায় রমজানের বাকি দিনগুলোতে মূল মৌসুমের তরমুজে ভালো দর পেয়ে লাভবান হবেন এমনই আশা চাষিদের।
আবহাওয়া ভালো থাকলেও এবার চাষবাস, সার-ওষুধ, শ্রমিক, পরিবহণ, আড়ৎদাড়ি, খাজনা থেকে লোড আনলোডিংয়ে বাড়তি খরচের কথা জানায় কয়েকজন চাষি। প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে মুখ না খুললেও কোথাও কোথাও নীরবে চাঁদা দাবি ও জলদস্যুদের হামলার কথাও জানায় চাষি ও পাইকাররা। কেউ আবার জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার তরমুজ কিনতে আগের মতো দল বেধে এসব চরাঞ্চলে পাইকার না আসার কথাও।
উপজেলার মূল ভূখণ্ডের ধানদী গ্রামের মঞ্জু মাতবর, সূর্যমণির পারভেজ, চন্দ্রদ্বীপের নিমদীর চর এলাকার খোকনসহ স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে নিজ এলাকায় একই জমিতে বারবার তরমুজ চাষের কারণে জমির উর্বরা হারিয়ে ভালো ফল না পাওয়ায় পাশের জেলা ভোলা, চরবিশ্বাস, গলাচিপা, চরকাজল এলাকা থেকে এসে রফিক গাজী, বাবুল খানসহ অর্ধশতাধিক চাষি বছর মেয়াদি জমি লিজ নিয়ে এবার তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন চরে তরমুজ চাষ করেছেন। বাম্পার ফলনও এসেছে আস্থা, গ্রেড-১, সুপার গ্রেড-১, লাকি, সুইট ক্যামিলি, ড্রাগনসহ বিভিন্ন জাতের তরমুজের।
চন্দ্রদ্বীপের চর নিমদী এলাকার তরমুজ চাষি খোকন ও ছোটডালিমা গ্রামের হাবিব হাওলাদার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূল রয়েছে। রোগবালাইও সহনীয় পর্যায়ে। অনেকে অধিক মুনাফার আশায় অপরিপক্ব পাকা আধা-পাকা তরমুজ কেটে মোকামে পাঠায়। ক্ষেতে শ’হিসেবে কিনলেও অসাধু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা কেজি দরে বিক্রি করেন। এতে চাষবাসের খরচের সঙ্গে পরিবহন, আড়তদারি, খাজনা থেকে লোড-আনলোডিংয়ে বাড়তি খরচ মেটাতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন ফাঁদে ও বাজার বিশৃঙ্খলায় পড়ে তরমুজে অর্ধেক মূল্য হাতে পান প্রকৃত তরমুজ চাষিরা। সরকারের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ঈদের আগে সুষ্ঠু সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার দাবি তুলে এরা বলেন, ‘কৃষিতে একমাত্র তরমুজ চাষেরই দায়ভার সরকার নেয় না। দুঃসময়ে চাষিদের পাশে থাকতে হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন Max tv bdকে জানান, ‘তরমুজ এখানকার সম্ভাবনাময় মৌসুমি ফল। বিভিন্ন রবি ফসলের সঙ্গে তেঁতুলিয়া নদী বেষ্টিত চন্দ্রদ্বীপের চরওয়াডেল, রায়সাহেব, চরঈশান, কচ্ছবিয়া, মমিনপুর, বাসুদেবপাশা, চরশৌলাসহ বিভিন্ন চরে এবার ৩৫০০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও মাঠপর্যায়ে তা ছাড়িয়ে গেছে। যা আগের বছরের প্রায় দেড়গুন। বাম্পার ফলন এসেছে। চাষিরা এবার লাভবান হবেন।