রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:১৬ পূর্বাহ্ন

আ.লীগ আমলে ৩৬ হিন্দু পরিবার উচ্ছেদ

প্রতিবেদকের নাম
  • প্রকাশের সময়ঃ রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৪৫ বার পঠিত হয়েছে
সুরুজ্জামান সরকার। ছবি : সংগৃহীত

নতুন সরকার গঠনের চার মাস চলছে। এরমধ্যেই উঠে আসছে নানা দাবি ও ইস্যু, করছে আন্দোলনও। এসব ঘটনার ভিড়ে সম্প্রতি বেশ আলোচিত হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা ইস্যু। কিছু সংখ্যক লোক দাবি তুলেছে বর্তমান না বিগত সরকারের সময় সনাতনীরা বেশি নিরাপত্তায় ছিল।

কিন্তু আসলেই কি এটা সত্য। জানতে তদন্ত শুরু করে জাতীয় পত্রিকা খবরের কাগজ। বেরিয়ে আসে নানা ঘটনা। এর মধ্যে একটি হলো- ময়মনসিংহের গাঙ্গিনারপাড়ের এ বি গুহ রোডের একটি ঘটনা। ১৯৯৯ সালে এই যায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয় ৩৬টি হিন্দু পরিবারকে। এর নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সুরুজ্জামান সরকার ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা দবির হোসেন ভূঁঞা।

উচ্ছেদ হওয়া সেসব ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ করা হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশ ময়মনসিংহ শহরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছেন। অনেকে চলে গেছেন ঢাকায়, কেউবা ভারতে। শুধু রয়ে গেছে তাদের রেখে যাওয়া বাড়ি-ঘর। তবে সেটাও এখন দখলে।জানা গেছে, স্বনামধন্য ব্যবসায়ী সুরুজ্জামান সরকারের হাতে এখন হিন্দু পাড়ার সব যায়গা। তার মালিকানায় আসা নিয়েও ভুক্তভোগী হিন্দুদের অভিযোগের শেষ নেই। ধনাঢ্য আর প্রভাবশালী হওয়ায় সুরুজ্জামানের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলবে, এমনটি কল্পনাও করতে পারে না কেউ।

কারণ সুরুজ্জামান সরকার ছিলেন সাবেক ধর্মমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের প্রধান অর্থদাতা। শহরে ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল মতিউর রহমানের যাবতীয় নির্বাচনিসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করতেন সুরুজ্জামান। সেই সূত্রে তিনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ভোগ করতেন।

ভুক্তভোগী হিন্দু পরিবারগুলোর দাবি, ভুয়া দলিল করে সুরুজ্জামান পুরো সম্পত্তি দখল করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওই পাড়ারই বাসিন্দা দবির হোসেন ভূঁঞা। ২৫ বছর আগেই পাড়ার সবাই চলে গেছেন অন্যত্র। আর চার-পাঁচটি পরিবার সেখানেই জমি কিনে বাস করছেন। এর পেছনেও আছে রহস্য। সুরুজ্জামান ও দবির দেখাতে চেয়েছেন, উচ্ছেদের ঘটনাটি যেন হিন্দু সম্পত্তি দখলের মতো কারও চোখে না পড়ে। সুরুজ্জামান জমির ভুয়া দলিল করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিজ নামে জমির মালিকানা নিয়েছেন উচ্চ আদালত থেকে। পুরো এলাকায় অন্তত তিন একর জমি রয়েছে।

এসব বিষয়ে ভুক্তভোগী এক প্রবীণ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১৯৬৭ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী ওরফে লাইলি মারা যান। সেখানে থাকা বাসাগুলোয় ভাড়া থাকতেন ৩৬টি হিন্দু পরিবার। একেক জনের সংসারে ছিল ৪ থেকে ৮ জন সদস্য। লালাশঙ্করের মৃত্যুর পর নিজেই সব সম্পত্তি দেখাশোনা করাসহ ভাড়া আদায় করতেন স্বর্ণকুমারী দেবী। কিন্তু একা সব সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল তার। এ জন্য বিনোদ রায় নামের একজনকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন। বিনোদ ছিলেন শিক্ষিত। ময়মনসিংহ শহরের এই বাসিন্দা সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করার সময় দবিরের পরিবারকে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে দেন বিনোদ। চাকরির সুবাদে ধীরে ধীরে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন বিনোদ। স্বামী-সন্তানহীন স্বর্ণকুমারীর জমি নিজের কবজায় নিতে কৌশল করতে থাকেন তিনি। ১৯৬৭ সালে লাইলি মারা যাওয়ায় সেই সুযোগ চলে আসে। লাইলির মৃত্যুর কিছুদিন পর বিনোদ এলাকায় ঘোষণা করেন, পুরো জমির মালিক তিনি নিজেই। লাইলির বাসায় বহু বছর ভাড়া থাকা ৩৬টি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। কারণ হিন্দু পরিবারগুলো জানত, বিশাল এই জমির মালিক লালাশঙ্কর রায়। তিনি লাইলিকে জমি লিখে দিয়ে যাননি। লাইলিও কারও কাছে জমি বিক্রি করার মতো বৈধ মালিক ছিলেন না। তাই লাইলি এক শতাংশ জমিও কারও কাছে বিক্রি করেননি। কিন্তু এরই মধ্যে জানাজানি হয়, বিনোদ জমি বিক্রি করে দিয়েছেন স্বদেশি বাজারের ব্যবসায়ী হাজি শামসুল হকের কাছে, যা পুরোপুরি অবৈধ ও জালিয়াতি।

আরেক ভুক্তভোগী প্রণব চক্রবর্তী বলেন, ‘লাইলিপট্টিতে আমাদের পরিবার বাস করে আসছিল। দাদার পর বাবাও একই এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তখন দেখতাম, পাড়ার এক পরিবারের একজন আরেকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মামলার খরচ জোগাড় করে চালাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। ফলে মামলার খরচ দিতে কষ্ট হতো তাদের। পরিবারসহ স্থানীয়রা বলাবলি করতেন, এই জমির মালিক নেই। অথচ হাজি শামসুল হক অবৈধ উপায়ে জমির মালিক দাবি করছেন।’

লাইলিপট্টির আরেক বাসিন্দা তবলেন, ‘লাইলিপট্টির জমি সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন মৃত দুলাল সেনের ছোট ছেলে বাসু সেন।’ কার্তিকের কথামতো শহরের ব্যবসায়ী বাসু সেনের কাছে গেলে অজানা ভয় আর আতঙ্কে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করতে রাজি হননি তিনি। কার্তিকের মতো একই বক্তব্য দিয়ে মৃত অবণী পালের ছেলে বরুন পাল বলেন, ‘এই সম্পত্তি নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কারণ আমার এতে কোনো লাভ নেই। সরকার চাইলে খতিয়ে দেখতে পারে।’ তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন শহরের একটি বেসরকারি কলেজের অঙ্কের শিক্ষক, মৃত জীবনকৃষ্ণ পালের ছেলে গৌতম পাল রুমন।

এসব অভিযোগের যোগাযোগ করা হয় দবিরের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। দবিরের ছোট ভাই কামাল হোসেন ভূঁঞা ওরফে মিঠু ভূঁঞা ও তার এক বড় ছেলে মাসুদ হোসেন ভূঁঞা টিটুকে। লাইলিপট্টির জমি সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ মেজাজে মিঠু ভূঁঞার ছেলে টিটু বলেন, জমির মূল মালিক ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। এই মালিকানা থেকে একপর্যায়ে হাজি শামসুল হক মালিকানায় আসেন। এরপর সুরুজ্জামানের কাছ থেকে আমার বড় চাচা দবির হোসেন ভূঁঞা কিনেছেন। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে জমি নেননি। তিনি ছিলেন ‘ক্লিন ইমেজের’ মানুষ। ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতৃত্বও দিয়েছেন দবির হোসেন ভূঁঞা।” কিন্তু সাল-তারিখ হিসেবে সেই দাবি ভিত্তিহীন বলে মনে হয় প্রতিবেদকের। কারণ সুরুজ্জামান জমি দখলে নেওয়ার অনেক আগেই দবির হোসেন ভূঁঞা লাইলিপট্টিতে বাস করে আসছিলেন। এমনকি ভাড়াটিয়া থেকে নিজের জমি বলে তিনি দয়াময় আশ্রমসহ পাড়ার বেশ কিছু অংশ বিক্রিও করেছেন। দবিরের ছোট ভাই মিঠুর বক্তব্যে সেই থেকে সন্দেহ আরও দানা বাঁধে।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত সুরুজ্জামান সরকার বলেন, ‘হাজি শামসুল হক আমার কাছে সেই জমি বিক্রি করেছেন। দবির হোসেন ভূঁঞাও আমার কাছ থেকেই জমি কিনেছেন।’ এ সময় তার কাছে জমির দলিল দেখতে চাইলে বলেন, ‘আমাকে পরে একদিন ফোন দিয়ে দিন-তারিখ ঠিক করে দলিল দেখাবেন।’ এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এই নিউজটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও খবর