বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪৫ অপরাহ্ন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল

প্রতিবেদকের নাম
  • প্রকাশের সময়ঃ বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫
  • ১০ বার পঠিত হয়েছে
ছবি : সংগৃহীত

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ।

বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন।

বেঞ্চের অপর ছয় বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

আপিল বিভাগ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো হলো-

>> পূর্বের রায় বাতিল ও আপিল মঞ্জুর : ​আদালত সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আগের রায়টিতে বেশ কিছু ভুল ছিল। ​তাই, আদালত আগের সেই রায়টিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছে।

​ফলস্বরূপ, এর সাথে সম্পর্কিত সব আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে এবং পুনর্বিবেচনার আবেদনগুলিও নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

>> তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার (এনপিসিজি) : ​এই রায়ের ফলে, সংবিধানের চতুর্দশ খণ্ডের ২এ অধ্যায়, যা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত, সেটি সক্রিয় ও পুনরুজ্জীবিত হলো।

এই ব্যবস্থাটি ১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল।

>> কার্যকারিতা শুরু হওয়ার শর্ত : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটলেও, এর কার্যক্রম শর্তসাপেক্ষ। ​এটি তখনই কার্যকর হবে, যখন ত্রয়োদশ সংশোধনীর ৫৮খ(১) এবং ৫৮গ(২) অনুচ্ছেদগুলোর বিধান কার্যকর করা হবে।

​>> ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্যতা : ​এই আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে, পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানগুলো কেবল ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, অতীতের কোনো ঘটনার উপর এই রায়ের সরাসরি প্রভাব পড়বে না, কিন্তু ভবিষ্যতের সবকিছুর জন্য এটি প্রযোজ্য হবে।

​এর বিস্তারিত রায় বা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পরে প্রকাশিত হবে।

২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে নতুন করে আইনি লড়াই শুরু হয়। চলতি বছরের ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদন মঞ্জুর করেন সর্বোচ্চ আদালত। দেওয়া হয় আপিলের অনুমতি। এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার ও পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক আপিল করেন।

এরপর ২২, ২৩, ২৮, ২৯ অক্টোবর এবং ২, ৪, ৫, ৬ ও ১১ নভেম্বর শুনানি হয়। শুনানি শেষ করে রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।

এ আপিলে বিএনপি মহাসচিবের করা আপিলের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতের করা আপিলের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে আপিল শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

এর আগে, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্ভব নয়। কারণ সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলা আছে। এখন তো কোনো সংসদ নেই। সংসদ ভেঙে গেছে এক বছরের বেশি সময় আগে। আমরা আশা করছি, চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। আমরা সব আবেদনকারী আপিল বিভাগে এর পরের নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছি।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চাপে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। ওই বছর ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এরপর এ পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।

২০০৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।

পরে রিট আবেদনকারীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালত এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন।

তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতি শুনানি গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন। এ ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকসহ চারজন। আর তিনজন ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বাতিলযোগ্য। তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ রায় ঘোষণার সাত দিন পর অর্থাৎ ১৭ মে অবসরে যান এ বি এম খায়রুল হক। অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘তবে প্রয়োজনের নিরিখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।’ এ পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়। পরে এ পূর্ণাঙ্গ রায়কে আশ্রয় করে দলীয় সরকারের অধীনে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকেন শেখ হাসিনা। জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট তার পতন ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়।

এই নিউজটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও খবর