বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, জোট শরিকদের জন্য প্রাথমিকভাবে ৪০টি আসনের কথা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী নির্বাচনী জোট হলেও নিজস্ব মার্কায় নির্বাচন করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল সেসব শরিক দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। এখনো যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি সেগুলোর কিছু আসন শরিক দলগুলোকে দেওয়া হবে। আর কিছু আসনে এখনো বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। কবে এসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিএনপি নেতারা আরো জানান, নিজস্ব মার্কায় নির্বাচন করতে হবে বলে জোটের জন্য আসন ছাড় নিয়ে আরো বেশি ভাবতে হচ্ছে। আর শরিক দলের প্রার্থীদের আসন ছাড় দেওয়ার পর যদি ওই এলাকার বিএনপির নেতাকর্মীরা তাঁদের পক্ষে জোরালোভাবে মাঠে না নামেন তাহলে তাঁদের পক্ষে জিতে আসা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে জোটের আসনসংখ্যা কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। যদি এনসিপির সঙ্গে জোট হয় তাহলে বিএনপি জোটে সবচেয়ে বেশি আসন তাদেরই ছাড় দেওয়া হবে। তবে জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতায় আরো সময় লাগবে।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জোটের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। তবে এর জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন। কারণ আমরা আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করব। তারপর বিএনপির সঙ্গে নেগোসিয়েশন হবে। লম্বা একটা প্রক্রিয়া। তবে আমরা আমাদের গরুর গাড়ি মার্কায় সারা দেশে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই আমরা প্রার্থী ঘোষণা করব।’
নাম প্রকাশ না করে বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘জোটে যেসব দল আছে সেগুলোর বেশির ভাগ নেতাকেই সাধারণ মানুষ চেনে না। তাদের মার্কাও জানে না। বড়জোর ওই সব দলের দু-একজন নেতাকে চেনে। এখন যদি জোটকে ৪০টি আসন ছাড় দেওয়া হয় তাহলে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এই সময়ে এই ঝুঁকি বিএনপির নেওয়াটা ঠিক হবে না। বরং বিএনপি তাদের নিজস্ব প্রার্থীদের মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলে জোটের নেতাদের বিভিন্ন পদে বসানোর সুযোগ থাকবে। নিশ্চয়ই জোটের নেতারা সেটা নিজেরাও বুঝবেন।’
বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে যেসব দল আলোচনায় আছে সেগুলো হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ এলডিপি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ একাধিক দল। এ ছাড়া এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির।
জানা যায়, শরিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীরা যেসব আসন থেকে নির্বাচন করতে চান সেখানে এখনো কোনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। শরিক দলের অনেকেই বিএনপির গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তাঁরা আগে থেকেই নির্দিষ্ট কিছু আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আরপিও সংশোধনের পর অনেকে তাঁদের নিজস্ব মার্কা নিয়েই প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে জোটের যেসব দলের নিবন্ধন নেই সেসব দলের নেতারা ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা-১৭ আসনে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির শরিক দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। ঢাকা-১৩ আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। ওই দুটি আসনেই বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর তাঁর নিজ এলাকা পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করতে এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। ২০২২ সাল থেকে বিএনপি যে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছিল তাতে যুক্ত ছিল গণঅধিকার পরিষদও। এই আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। একইভাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান নির্বাচন করতে চান ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে। এই আসনেও বিএনপি প্রার্থী দেয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে বিএনপির জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির। ওই আসনেও দলীয় কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি বিএনপি। যদিও গতকাল গণসংহতি ৯৪ আসনে তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় সমঝোতা গড়ে উঠেছে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার। সে কারণে আসন সমঝোতার প্রশ্নেও বিএনপিসহ যুগপৎ ধারার আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলমান।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক চট্টগ্রাম-১৪ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। বগুড়া-২ আসনে প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার। পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র সাহাদাত হোসেন সেলিমের প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র সাহাদাত হোসেন সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রয়োজনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গেও বৈঠক হবে। আমরা দ্রুতই আমাদের ঘোষণা চাচ্ছি। তবে কাউকে কাউকে মৌখিকভাবে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। ওই সব আসনে প্রার্থীও ঘোষণা করেনি বিএনপি। আমরা যারা গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছি তারা এলাকায় প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে। ঝালকাঠি-১ আসনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। এসব আসনেও বিএনপি কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। এর বাইরেও আরো কিছু আসন বিএনপি তাদের শরিক দলগুলোর জন্য ফাঁকা রেখেছে।
গত সোমবার রাতে দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের (বিএনপির) সঙ্গে যাঁরা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, যেসব আসনে তাঁরা আগ্রহী, সেসব আসনে আমরা কোনো প্রার্থী দিইনি। আমরা আশা করছি, তাঁরা তাঁদের নাম ঘোষণা করবেন, তখন আমরা চূড়ান্ত করব।’
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা না করা ৬৪ আসন : বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা না করা ৬৪টি আসন হলো ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর-৫, নীলফামারী-১ ও ৩, লালমনিরহাট-২, বগুড়া-২, নওগাঁ-৫, নাটোর-৩, সিরাজগঞ্জ-১, পাবনা-১, ঝিনাইদহ-১, ২ ও ৪, যশোর-৫, নড়াইল-২, বাগেরহাট-১, ২ ও ৩, খুলনা-১, পটুয়াখালী-২ ও ৩, বরিশাল-৩, ঝালকাঠি-১, পিরোজপুর-১, টাঙ্গাইল-৫, ময়মনসিংহ-৪ ও ১০, কিশোরগঞ্জ-১ ও ৫, মানিকগঞ্জ-১, মুন্সীগঞ্জ-৩, ঢাকা-৭, ৯, ১০, ১৩, ১৭, ১৮ ও ২০, গাজীপুর-১ ও ৬, নরসিংদী-৩, নারায়ণগঞ্জ-৪, রাজবাড়ী-২, ফরিদপুর-১, মাদারীপুর-১ ও ২, সুনামগঞ্জ-২ ও ৪, সিলেট-৪ ও ৫, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৬, কুমিল্লা-২ ও ৭, লক্ষ্মীপুর-১ ও ৪, চট্টগ্রাম-৩, ৬, ৯, ১১, ১৪ ও ১৫ এবং কক্সবাজার-২।