সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন

একেকটি পরিবার নিমেষেই শে-ষ সড়কে \স্বজনের বিদায়ে প্রিয় আঙিনা ভিজেছে চোখের জলে

প্রতিবেদকের নাম
  • প্রকাশের সময়ঃ সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫
  • ১৬ বার পঠিত হয়েছে
একেকটি পরিবার নিমেষেই শেষ সড়কে

মায়ের অপেক্ষা যেন চির অভিমানে পরিণত হলো। তিন বছর পর প্রবাস থেকে ফেরা সন্তানকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন ঠিকই; কিন্তু সন্তানের কাঁধে লাশ হয়ে। এই মৃত্যুযাত্রায় তিনি একা নন সঙ্গী হয়েছেন একই পরিবারের আরও ছয়জন। শিশু সন্তান থেকে শুরু করে বয়স্ক নানি; সাতজনের লাশের সারি আর স্বজনের আহাজারিতে ভরে ওঠে আবদুল বাহারের ঘরের উঠান। স্বজনের বিদায় দিয়ে প্রিয় আঙিনা ভিজেছে চোখের জলে।

গত ৬ আগস্ট বুধবার বাড়ি থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব জগদীশপুর এলাকায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি শুধু পরিবারটির কান্না নয়, দীর্ঘশ্বাস হয়েছে সারা দেশের মানুষের।

সাধারণত একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ কিছু মানুষ আক্রান্ত হন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের গন্তব্য এক থাকলেও তেমন কারো সঙ্গেই কারও পরিচয় থাকে না। দুর্ঘটনায় নিহতদের ঘরবাড়ি আলাদা হয়। তবে স্বজন হারানোর বেদনা, আহাজারির সুর একই। শোকের ছায়ায় ঢেকে দেয় সেসব পরিবারের হাসিমুখগুলো।

আগে ২৯ মার্চ বরগুনার পাথরঘাটায় এক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় তিন সহোদরের; কিন্তু দুর্ঘটনা এমনও হয়, যেখানে বিলাপ করার জন্য আপন পরিবারের কেউই আর বেঁচে থাকে না। সেখানে দাফনের দায়িত্ব পড়ে নিকট আত্মীয়র হাতে। আর লাশের খাটিয়া ওঠে প্রতিবেশীর কাঁধে।

গত ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পরিবারের সবার মৃত্যু হয়েছে, এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৮৫টি। এসব দুর্ঘটনায় বাবা-মা, সন্তানসহ পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে নিহত হয়েছেন। গত কয়েক মাসে এমন অনেক দুর্ঘটনার খবর এসেছে, যেখানে একটি গাড়িতে থাকা মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই মারা গেছেন ঘটনাস্থলেই।

গত ৮ মে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের নিমতলা এলাকায় আরেকটি দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজন মারা গেছেন। চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীর সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা স্বজনের মৃত্যু হয়। এর ঠিক দুদিন আগে অর্থাৎ ৬ মে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে ডাম্প ট্রাক ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। ৩০ মার্চ ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বালুবাহী ট্রাকের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষে এক পরিবারের চারজন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

২০২৩ সালের জুন মাসে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে এক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের ছয়জন নিহত হন। ওই পরিবারের বাবা-মা, দুই সন্তান, চাচা এবং দাদি একসঙ্গে মারা যান। এ ধরনের ঘটনা এখনো থামছে না, এতে নিঃস্ব হচ্ছে পরিবারগুলো।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগেই দেখা গেছে, গন্তব্যে যাওয়ার পথে পরিবারের সবাই একই গাড়িতে ছিল, যা ট্রাক বা বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ১২টি ঘটনায় একসঙ্গে পুরো পরিবার নিহত হয়েছে। আর ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮৪টি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান  বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণে দেখেছি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং অ্যাম্বুলেন্সের যাত্রী হিসেবে একসঙ্গে পুরো পরিবার বা এক পরিবারের অধিক সদস্য নিহতের প্রবণতা বেড়েছে। প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। সড়ক অবকাঠামো বিস্তৃত হওয়ায় পরিবারের সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বা কোনো কাজে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।’

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক এবং তদারকির অভাব–এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এসব দুর্ঘটনা ঘটছে আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। যেখানে ওভারটেকিং, বিপরীতগামী যানবাহনের সংঘর্ষ এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি উল্টে যাওয়া, দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িকে পেছন থেকে আরেক গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার মতো ঘটনা বেশি।

নোয়াখালীর এই দুর্ঘটনা নিয়ে আবদুল বাহার অভিযোগ করছিলেন, ‘চালকের চোখে ঘুম ছিল। সে কুমিল্লাতেও একবার দুর্ঘটনায় পড়ার অবস্থা তৈরি করে।’ নোয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের চৌমুহনী স্টেশনের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকও দুর্ঘটনার পেছনে ‘চালকের ঘুম ঘুম ভাব’ থাকাকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছেন।

বিশ্রামবিহীন চালকের নিয়ন্ত্রণহীনতা দুর্ঘটনা বাড়ছে: প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু বাড়ছে। তিন বছরের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবহন চালক ও শ্রমিকের মৃত্যু প্রায় ১ হাজার বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত চালকের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। চালকের গাড়ি চালনা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার মধ্যে সীমিত রাখা হচ্ছে না। আইন থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। এতে দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ১৮৮ জন চালক ও সহকারী। আগের বছর ২০২১ সালে মারা গেছেন ১ হাজার ৮৬৬ জন। ২০২০ সালে ১ হাজার ২৬৬ জন এবং ২০১৯ সালে এক হাজার ১৯০ জন মারা গেছেন। দেখা যাচ্ছে, এই চার বছরে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়েছে।

এ দিকে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পরিবহন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে বলেছে। আইনের ৩৯(১) ধারায় উল্লেখ আছে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নং আইন) এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনারদের কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করতে পারবে। সেইসঙ্গে ৩৯(২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অথবা পরিবহন যানের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার-কাম-ক্লিনার উপধারা (১)-এর অধীন নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল মেনে চলবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক   বলেন, গোটা বিশ্বেই চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালককে টানা গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না। একজন চালকের একটানা গাড়ি চালানোর আন্তর্জাতিক অনুমোদন নেই। এটি সংশ্লিষ্টরা মনিটর করবে।

আইনে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও মেনে চলার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নেই। শ্রম আইনের ১০০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক আট ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। আবার শ্রম আইনের ১০১ (গ) ধারায় বলা হচ্ছে, এই আট ঘণ্টার মধ্যে দুবার কর্ম বিরতি দিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস   বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’

এই নিউজটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও খবর