শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্মরণীয়। জিয়ার অবদান শুধু মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রে রূপান্তরের দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন; যা আজও দেশের উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। আর জিয়া কাজের মাধ্যমে এখনো বেঁচে আছেন কোটি প্রাণে।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেকে চেয়ারম্যান করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি ৩০০টির মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। ১ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ৯ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনী কার্যকর হওয়ার পর সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। দেশে আবার নির্বাচনী রাজনীতি চালু হয়। দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হওয়া জিয়াউর রহমানের সত্যিই একটি বড় অর্জন।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগণের একটি নতুন জাতীয় পরিচয় হিসেবে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রবর্তন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশের মতো একটি বহুবচন সমাজে মানুষ বিভিন্ন জাতিসত্তার এবং যেখানে তারা বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস করে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন জীবনধারা রয়েছে, সেখানে জাতীয়তাবাদকে ভাষা বা সংস্কৃতির পরিবর্তে ভূখণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা উচিত।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, সংস্কৃতি এবং জাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জাতীয় ঐক্য এবং একত্রীকরণের উপর জোর দেয়।
দেশ পরিচালনায় জিয়ার পরিকল্পনাগুলো ছিল সরল, বাস্তবসম্মত এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে নিবেদিত। খাল কাটা থেকে শুরু করে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, রাস্তার ধারে ফলের গাছ লাগানো, বাড়িতে মুরগির খামার এবং পুকুরে মাছ চাষের মতো উদ্যোগগুলো তার দূরদর্শিতার প্রমাণ। সেসব কাজগুলো যদি আজও সচল থাকতো তাহলে হয়তো বিদেশিদের কাছে আমাদের হাত পাতা লাগত না।
খাল কাটা: কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণশক্তি
জিয়াউর রহমানের “খাল কাটা” কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে এই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের অসংখ্য খাল পুনঃখনন ও সংস্কার করা হয়। এর ফলে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা মেলে এবং গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এই উদ্যোগ কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিল, বিশেষ করে ধান ও অন্যান্য শস্য।
উদাহরণস্বরূপ, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের অনেক কৃষক এই কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়মিত পানি সরবরাহ পেয়েছিলেন, যা তাদের বছরে একাধিক ফসল ফলাতে সাহায্য করে। এছাড়া খালগুলো নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে গ্রামীণ বাজারে পণ্য পরিবহনকে সহজ করেছিল। এই কর্মসূচি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ: রেমিট্যান্স অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন
জিয়াউর রহমান প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশের বিশাল জনশক্তি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে একটি সম্পদ হতে পারে। ১৯৭৬ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েতে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আজ বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ, এবং এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী নীতির মাধ্যমে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে এই শ্রমিকরা দেশে যে অর্থ পাঠাতে শুরু করেছিল, তা গ্রামীণ পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই উদ্যোগের ফলে লাখো পরিবার দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে।
রাস্তার ধারে ফলের গাছ: পরিবেশ ও জনগণের সমন্বয়
জিয়াউর রহমানের আরেকটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ ছিল রাস্তার পাশে ফলের গাছ লাগানো। এই পরিকল্পনা শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যই ছিল না, বরং গ্রামীণ জনগণের জন্য একটি পুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।
আম, কাঁঠাল, নারকেল এবং লিচুর মতো ফলের গাছ লাগানোর মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণি, বিনামূল্যে ফল পেতে পারে। এই গাছগুলো গ্রামীণ রাস্তাগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে এবং স্থানীয় বাজারে ফল সরবরাহে সহায়তা করেছে।
এ ছাড়া এই উদ্যোগ পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ গাছগুলো কার্বন-ডাই অক্সসাইড শোষণ এবং ছায়া প্রদানের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক ছিল। এটি ছিল প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয়ের উদাহরণ।
বাড়িতে বাড়িতে মুরগির খামার: গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন
জিয়াউর রহমানের “বাড়িতে বাড়িতে মুরগির খামার” কর্মসূচি ছিল গ্রামীণ পরিবারগুলোকে স্বনির্ভর করার একটি অভিনব উদ্যোগ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারকে মুরগি পালনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল, যা তাদের জন্য ডিম ও মাংসের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।
এই উদ্যোগ বিশেষভাবে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নারীরা এই খামারগুলো পরিচালনা করে নিজেদের পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত ডিম ও মুরগি বিক্রি করে আয় করতে পেরেছিলেন। এই কর্মসূচি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
পুকুরে মাছ: খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা
জিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল “পুকুরে মাছ” কর্মসূচি। এই উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবারগুলোকে তাদের পুকুরে মাছ চাষে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি, বরং স্থানীয় বাজারে মাছ সরবরাহ বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনেছিল।
রুই, কাতলা, মৃগেলের মতো মাছ চাষের জন্য সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল, যা গ্রামীণ জনগণের জন্য একটি টেকসই আয়ের উৎসে পরিণত হয়। এই কর্মসূচি বাংলাদেশের মৎস্য খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
জনগণের সঙ্গে সংযোগ: জিয়ার নেতৃত্বের সারমর্ম
শহীদ জিয়াউর রহমানের এই উদ্যোগগুলোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার জনগণের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল শক্তি রয়েছে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে। তার প্রতিটি পরিকল্পনা ছিল জনকেন্দ্রিক এবং বাস্তবসম্মত। তিনি শুধু নীতি প্রণয়ন করেননি, বরং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করেছিলেন। তার আমলে গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, গ্রাম সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিলেন, যা গ্রামীণ জনগণের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিয়েছিল।
শহীদ জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী উদ্যোগগুলো আজও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রেরণা যোগায়। তার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপগুলো শুধু তৎকালীন সময়ে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করেনি, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছিল।
তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে এবং দেশ হবে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য পাথেয়, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ।